নারায়ণগঞ্জের পাইকপাড়ার জঙ্গি আস্তানায় পুলিশের অভিযানে নিহত হয়েছে গুলশান ও শোলাকিয়া হামলার মাস্টারমাইন্ড তামিম আহমেদ চৌধুরী। অপারেশন হিট স্ট্রং-২৭ নামে ৪৫ মিনিটের ওই অভিযানে মানিক (৩৫) ও ইকবাল (২৫) নামে তার দুই সহযোগী জঙ্গিও নিহত হয়েছে। গতকাল সকাল সাড়ে ৮টায় পাইকপাড়া কবরস্থানের পাশে শাহসুজা সড়কের নুরুদ্দিন দেওয়ানের ৪১০/১ নম্বর বাড়িতে এ অভিযান শুরু করে পুলিশের স্পেশাল উইপনস অ্যান্ড ট্যাকটিকস (সোয়াট) টিম। পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট, র্যাব-১১ ও নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশ অভিযানে সহযোগিতা করে। নিহত তামিমকে ধরিয়ে দিতে পুরস্কার ঘোষণা করেছিল পুলিশ। অভিযান শুরুর পর পুলিশের দেয়া আত্মসমর্পণের সুযোগ প্রত্যাখ্যান করে জঙ্গিরা পুলিশকে লক্ষ্য করে গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। গুলি ছুড়ে। পুলিশও পাল্টা গুলি চালায়। পুলিশের স্নাইপার রাইফেলের গুলিতে মারা যায় তিন জঙ্গি। অপারেশন শেষ হয় সোয়া নয়টায়। ঘটনাস্থল থেকে জঙ্গিদের ব্যবহার করা একে-২২ রাইফেল, পিস্তল, চাপাতি, গ্রেনেড, দুরবিনসহ বেশকিছু বইপত্র উদ্ধার করা হয়েছে। সন্ধ্যায় তিন জঙ্গির লাশ উদ্ধার করে নারায়ণগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে নেয়া হয়। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে ছুটে যান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও পুলিশের মহাপরিদর্শক একেএম শহীদুল হকসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার ছানোয়ার হোসেন বলেন, ২০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষিত মোস্ট ওয়ানটেড জঙ্গি মাস্টারমাইন্ড তামিম চৌধুরীর নারায়ণগঞ্জের ওই বাসায় ঘাপটি মেরে থাকার বিষয়টি শুক্রবার রাতেই জেনেছে টেররিজম ইউনিট। ময়মনসিংহের ত্রিশাল থেকে আটক তামিমের এক সহযোগীর কাছ থেকে এই তথ্য জানা যায়। নিশ্চিত হওয়ার জন্য শেষ রাতেই পুলিশ সদস্যরা ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জের উদ্দেশে রওনা দেন। ভোরে পৌঁছেন নারায়ণগঞ্জ শহরের দক্ষিণ প্রান্তের পাইকপাড়ায়। এরপর পুলিশ সদস্যরা সাধারণ পোশাকে ওই তিনতলাবিশিষ্ট ভবনটিতে ঢোকেন। কথা বলেন, বাড়ির মালিক নুরুদ্দিন দেওয়ানের সঙ্গে। তাকে পুলিশের কাছে থাকা তামিমের ছবি দেখানো হয়। তিনি ওই ছবির চেহারার লোকটি তার বাসায় আছে বলে নিশ্চিত করেন। এরপর সাদা পোশাকধারী পুলিশ সদস্যরা বাড়িটির প্রতি নজর রাখে। খবর পাঠানো হয় ঢাকায়। পরে বিপুল সংখ্যক পুলিশ সদস্য ওই এলাকায় জড়ো হতে থাকে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘটনাস্থলে বাড়তে থাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের উপস্থিতিও। উপস্থিত হয় র্যাব-১১ এর সদস্যরা। নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশ। ঘিরে ফেলে পুরো এলাকা। সড়কের দু’দিকে অবস্থান নেয় পুলিশ সদস্যরা। দুদিক থেকে বন্ধ করে দেয়া হয় ওই সড়ক। এক পর্যায়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছে সোয়াট টিম। পৌঁছেই তারা তিনতলার বাড়িটি ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে। তিনতলা ভবনের দ্বিতীয় তলার পুরো ফ্ল্যাটে থাকেন বাড়ির মালিকের পরিবার। বাকি দুটি তলায় দু’টি করে ৪টি ইউনিট। উপর তলার উত্তর পাশের ফ্ল্যাটে ছিল ৩ জঙ্গির অবস্থান। নানা পারিপার্শ্বিকতা পর্যালোচনা করে অপারেশনের ছক কষা হয়। হ্যান্ড মাইকে পুলিশ জঙ্গিদেরকে আত্মসমর্পণের জন্য বলে। তা প্রত্যাখ্যান করে জঙ্গিরা বাড়ির জানালা দিয়ে পুলিশকে লক্ষ্য করে গ্রেনেড ও গুলি ছুড়তে থাকে। তামিমের হাতে ছিল গ্রেনেড ও অন্য দু’জনের হাতে ছিল অস্ত্র। পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে অভিযানের জন্য প্রস্তুতি নেয় সোয়াট টিমও। সকাল সাড়ে আটটায় শুরু হয় অভিযান। পুলিশ তৃতীয় তলায় জঙ্গিদের সঙ্গে থাকা অস্ত্র ও বোমার মজুত দেখে নিশ্চিত হয় যে, তা শুধু আত্মরক্ষাই নয়, বরং বড় হামলার জন্যও যথেষ্ট। আর পুলিশকে লক্ষ্য করে তারা গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটিয়ে যাচ্ছিল। পুলিশও তাদের লক্ষ্য করে পাল্টা গুলি ছোড়ে। ৪৫ মিনিটের মধ্যেই তিন জঙ্গিকে নির্মূল করতে সক্ষম হয় পুলিশ। অভিযানের বিষয় টের পেয়ে জঙ্গিরা অনেক তথ্য-প্রমাণ নষ্ট করেছে। ভেঙে ফেলেছে নিজেদের ব্যবহারের ল্যাপটপ। পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে কাগজপত্র। এদিকে জঙ্গিদের ছোড়া দু’টি গ্রেনেড নিচে টিনশেড বাসার চালের উপর পড়ে। পরে সেগুলো উদ্ধার করে পুলিশের বোমা নিষ্ক্রিয়করণ টিম। এরপর দুপুর ১টা ৪০ ও ৪৬ মিনিটে পর পর দু’টি বোমা নিষ্ক্রিয় করতে দেখা গেছে। এর আগে উদ্ধার করা আরো দুটো গ্রেনেড নিষ্ক্রিয় করা হয়। স্থানীয় বাসিন্দা মহিউদ্দিন আহমেদ মানবজমিনকে বলেন, সকালে নামাজ পড়ার জন্য আমি পাইকপাড়া কবরস্থানের পাশের মসজিদে আসি। দেখি ৭-৮ জন গেঞ্জি পরা লোক পায়চারি করছে। মোবাইলে কথা বলছে। সাতটার দিকে তারা আমাদের এলাকা থেকে সরে যেতে বলে। পরে দেখি পুলিশের গাড়ি জড়ো হতে শুরু করে। পুলিশের সংখ্যাও বাড়তে থাকে। সকালে গুলির শব্দ শুনতে পাই। এদিকে পাশের টিনশেড বাসায় থাকেন রাজমিস্ত্রি রায়হান ও বজলুর রহমান। সকাল আটটার দিকে তারা পাশের অপর একটি বাসায় কাজের জন্য বের হন। তখন অস্বাভাবিক তেমন কিছুই আঁচ করতে পারেন নি। কাজে গিয়ে শুনেন এই এলাকায় পুলিশি অভিযান শুরু হচ্ছে। কাজ করাবে না মালিক। তারপর তারা বাসায় ফিরতে গিয়েই দেখে তাদের বাসায়ই এই অভিযান। দুপুর পর্যন্ত তারাও তাদের বাসায় ঢুকতে পারেননি। স্থানীয় বাসিন্দা রায়হান ও বজলুর রহমান মানবজমিনকে বলেন, ওই ফ্ল্যাটে আগে একটি পরিবার থাকতো। তাদের সঙ্গে আমাদের মাঝে মধ্যে কথা হতো। দেড়-দু’মাস আছে নতুন ব্যাচেলর ভাড়াটিয়া আসে। তাদের সঙ্গে আমাদের তেমন কথা হতো না। তাছাড়া বাড়ির মালিক আড্ডা পছন্দ করতেন না। তাই আমরাও খুব একটা ছাদে যেতাম না। টেলিস্কোপযুক্ত স্নাইপারের নির্ভুল নিশানা: পাইকপাড়ার অভিযানে পুলিশের অত্যাধুনিক স্নাইপার রাইফেলের গুলিতেই নিহত হয়েছে তামিম আহমেদ চৌধুরীসহ তিন জঙ্গি। আত্মসমর্পণের সুযোগ দেয়া হলেও তারা সেই সুযোগ না নিয়ে পুলিশের ওপর গুলি ও গ্রেনেড হামলা চালায়। এ সময় পুলিশ স্নাইপার রাইফেল দিয়ে জঙ্গিদের গুলি করে। এতে দুই সহযোগী মানিক ও ইকবালসহ তামিম চৌধুরী নিহত হয়। অভিযান পরিচালনার সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তারা জানান, গোয়েন্দা তথ্য পাওয়ার পর পাইকপাড়া কবরস্থানের পাশে তিনতলা বাড়িটিতে ‘অপারেশন: হিট স্ট্রং ২৭’ পরিচালনার ছক তৈরি করা হয়। জঙ্গিরা যেন পালাতে না পারে, সে জন্য আগে থেকেই ঘটনাস্থলের চারপাশ ঘিরে রাখেন কাউন্টার টেররিজম ইউনিটসহ পুলিশের অন্য টিমের সদস্যরা। আত্মসমর্পণের সুযোগ দেয়া হলেও তারা সেই সুযোগ নেয়নি। উপরন্তু তারা পুলিশকে লক্ষ্য করে একের পর এক গ্রেনেড ছুড়ে মারে। একইসঙ্গে একে-২২ রাইফেল দিয়ে গুলি করতে থাকে। এরপর পুলিশও পরিকল্পনা অনুযায়ী অভিযান শুরু করে। অভিযানে থাকা সোয়াত টিমের সদস্যরা অন্যান্য অস্ত্রের সঙ্গে স্নাইপার রাইফেলও ব্যবহার করেন। অভিযানে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা আরো জানান, স্নাইপার রাইফেল দিয়ে টেলিস্কোপের সাহায্যে নির্ভুলভাবে নির্দিষ্ট দূরত্ব থেকে টার্গেটকৃত ব্যক্তিকে গুলি করা সম্ভব হয়। এই রাইফেল দিয়ে দ্রুত শক্তিশালী বুলেট ছোড়া যায়। ছবিও তোলা যায় স্নাইপার রাইফেলের টেলিস্কোপ দিয়ে। জঙ্গি আস্তানায় দুরবিন: এদিকে অভিযানের পর জঙ্গিদের ব্যবহৃত জিনিসপত্রের সঙ্গে দুটি দুরবিন পাওয়া গেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অনুমান, বাসা থেকে দূরে লক্ষ্য রাখা বা নিজেদের সুরক্ষার কাজেই এটিকে ব্যবহার করা হয়ে থাকতে পারে। এছাড়া, সকালে এলাকাটি ঘিরে ফেললে অভিযানের সম্ভাবনা দেখতে পেয়ে আস্তানায় থাকা নথিপত্র পুড়িয়ে ফেলে জঙ্গিরা। তবে সেখান থেকে বেশকিছু বই ও কাগজ উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। অভিযান শুরুর পর জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ডিএসবি) ফারুক হোসেন জানান, অভিযানের খবর পেয়ে জঙ্গিরা বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। তারা এ সময় গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র পুড়িয়ে ফেলে। পরবর্তী সময়ে প্রকাশিত ছবিতে ঘরের পোড়া কাগজের বান্ডিল দেখা যায়। এছাড়া, রিয়াদুস সালেহীনসহ কিছু বই, একটি দুরবিন, একটি চশমা, কম্পিউটারের যন্ত্রাংশ এদিক-ওদিক পড়ে থাকতে দেখা যায়। নিহত তিন জঙ্গির ছবি প্রকাশ: পাইকপাড়ায় চালানো ‘অপারেশন হিট স্ট্রং ২৭’ অভিযান শেষে নিহত তিন জঙ্গির ছবি প্রকাশ করেছে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট। নিহত তিন জঙ্গির মধ্যে গুলশান ও শোলাকিয়া হামলার মাস্টার মাইন্ড হিসেবে অভিযুক্ত তামিম আহমেদ চৌধুরী ও তার সহযোগী মানিক ও ইকবাল। পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, নিহত দুই জঙ্গি মানিক ও ইকবাল কল্যাণপুরে জঙ্গি আস্তানায় অভিযানের সময় ছিল বলে সন্দেহ করছেন তারা। পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ‘মানিক ও ইকবালের হাতের আঙুলের ছাপ সংগ্রহ করা হয়েছে। জাতীয় নির্বাচন কমিশনে রক্ষিত জাতীয় পরিচয়পত্রের সার্ভারে তাদের হাতের ছাপের সঙ্গে তা মিলিয়ে দেখা হবে। একইসঙ্গে কল্যাণপুর অভিযানে গুলিবিদ্ধ হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন জঙ্গি রাকিবুল হাসান রিগ্যানকে তাদের ছবি দেখিয়ে পরিচয় শনাক্ত করার চেষ্টা করা হবে। চেহারা পাল্টায়নি তামিম: গুলশান ও শোলাকিয়াসহ বিভিন্ন জঙ্গি হামলার মাস্টারমাইন্ড হিসেবে চিহ্নিত তামিম আহমেদ চৌধুরী পুলিশের আশঙ্কা থাকলেও নিহত হওয়ার আগ পর্যন্ত চেহারায় কোনো পরিবর্তন আনেনি। এ পর্যন্ত গণমাধ্যমে পুলিশের পক্ষ থেকে তার মুখাবয়বের যেসব ছবি প্রকাশিত হয়েছে তাতে তার মুখে ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি দেখা গিয়েছিল। সে সময় পুলিশের পক্ষ থেকে আশঙ্কা করা হয়েছিল দাড়ি কেটে বা গোঁফ রেখে চেহারার পরিবর্তন এনে লুকিয়ে থাকতে পারে সে। তবে তামিম আত্মগোপনে থাকলেও নিজের চেহারায় কোনো পরিবর্তন আনেনি। অপারেশন হিট স্ট্রং-২৭ এ নিহত হওয়ার পর তার মরদেহের যে ছবিটি পুলিশ প্রকাশ করেছে তাতে তামিম চৌধুরীর চেহারায় কোনো পরিবর্তন দেখা যায়নি। আগের মতোই তার মুখে ফ্রেঞ্চ কাট দাড়িই রয়েছে। পরনে ছিল বেল্টসহ গ্যাভার্ডিন প্যান্ট ও নেভি ব্লু টি-শার্ট। চেহারাতে বিশেষ কোনো পরিবর্তন দেখা যায়নি।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.