ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদহার আবাসন খাতের বড় প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে মনে করছেন এ খাতের সংশ্লিষ্টরা। তাঁদের মতে, একদিকে ব্যবসা সম্প্রসারণ ও দেনা পরিশোধে আবাসন প্রতিষ্ঠানগুলোকে গুনতে হচ্ছে উচ্চ সুদ, অন্যদিকে ক্রেতাও পাওয়া যাচ্ছে না।
রিয়েল এস্টেট হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (রিহ্যাব) নেতারা জানান, আবাসন খাতের জন্য দেওয়া ঋণে ব্যাংকগুলোর ঘোষিত সুদের হার ১২-১৫ শতাংশ। কিন্তু বিভিন্ন গৌণ চার্জ ও ফি মিলিয়ে এর হার দাঁড়ায় ১৬-১৯ শতাংশ বা তারও বেশি। ব্যাংক ঋণের এমন উচ্চ সুদে বিপাকে পড়েছেন ব্যবসায়ীরা। আর সহজ শর্ত ও স্বল্প সুদে ঋণ না পাওয়ায় ক্রেতাদেরও ফ্ল্যাট কেনার প্রতি আগ্রহ কমেছে।
ব্যাংক সুদ প্রসঙ্গে রিহ্যাবের মুখপাত্র ও প্রথম সহসভাপতি লিয়াকত আলী ভূঁইয়া বলেন, ‘ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদহার আবাসন খাতের প্রধান সংকট। এখানে বিনিয়োগের ঝুঁকি কম হলেও ব্যাংকগুলো ঋণ দিতে আগ্রহ দেখায় না। দেশের স্বল্প আয়ের মানুষের সিঙ্গেল ডিজিট হারে ঋণ দিলে আবাসনে সুদিন আসবে। সম্প্রতি সুদহার কিছুটা কমলেও এখনো অনেক বেশি।’
বিভিন্ন দেশের আবাসন খাতের জন্য দেওয়া ব্যাংক ঋণের তথ্য ধরে লিয়াকত আলী ভূঁইয়া বলেন, মালয়েশিয়ায় আবাসন খাতে দেওয়া ব্যাংক ঋণের সুদহার ৬ শতাংশের কম। জাপানে আড়াই থেকে ৩ শতাংশ। আর ফ্রান্সে এর হার ৩-৫ শতাংশ। প্রতিবেশী ভারতেও সুদের হার ১০ শতাংশের নিচে। এমন প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে উচ্চ সুদহার গৌণ চার্জ ও প্রসেসিং ফির কারণে আবাসন ঋণে আগ্রহী হচ্ছে না।
সরকারি প্রতিষ্ঠান হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স করপোরেশনের (এইচবিএফসি) সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার মো. বদিউজ্জামান বলেন, ‘আমাদের প্রতিষ্ঠানের সুদহার কম হলেও ফ্ল্যাট বা প্লটের ক্ষেত্রে ঋণ দেওয়া হয় না। মূলত ব্যক্তিগত জায়গায় বাড়ি নির্মাণে এইচবিএফসি ঋণ দেয়। এর মধ্যে ঢাকা ও চট্টগ্রামে ১২ শতাংশ। এর বাইরের এলাকায় সুদের হার ১০ শতাংশ। এইচবিএফসির ঋণ চাহিদা থাকলেও আর্থিক সংকটের কারণে ঋণ দিতে পারছে না।
আবাসন খাতের বিপর্যয় নিয়ে রাজউক পরিচালক (উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ) মো. গোলাম মোস্তফা বলেন, ‘ব্যাংকের উচ্চ সুদের হার আবাসন ধসের বড় কারণ। সুদের হার ফ্ল্যাটের দাম বাড়ার চেয়ে বেশি হলে বিনিয়োগকারীর লোকসান হবে। তাঁরা ফ্ল্যাট না কিনে ব্যাংকে টাকা রাখবেন। ব্যাংক ঋণে ফ্ল্যাট কিনবেন না। এর কারণেও বেচাকেনা কমছে।’
মাকান গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শাহজাহান বলেন, ‘আবাসনকে চাঙ্গা করতে রিহ্যাবের মাধ্যমে একটি তহবিল গঠনের দাবি জানিয়েছি। যে তহবিল স্বল্প ও মধ্যবিত্তদের কম সুদে দীর্ঘ মেয়াদে ঋণ দেবে। এ ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের পুনঃঅর্থায়ন তহবিলটি পুনরায় চালু ও সরকারের বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্ত দরকার।’
আবাসন খাতসংশ্লিষ্টদের মতে, অর্থায়নের ক্ষেত্রে ব্যাংক ঋণের সুবিধা না বাড়ায় ক্রেতাসংখ্যা বাড়ছে না। সম্ভাবনাময় এ খাতকে বাঁচাতে সরকারের নীতিগত সহায়তা জরুরি। কিন্তু তা না করে ফ্লট ও ফ্ল্যাট নিবন্ধন ফিসহ প্রতিটি খাতের ব্যয় বাড়িয়েছে সরকার। এতে অনেকের ফ্ল্যাট কেনার স্বপ্ন থাকলেও তা বাস্তবে রূপ দিতে পারছে না।
পুনঃঅর্থায়ন তহবিল চালুর দাবি
ক্রেতার অর্থায়নের উৎসগুলোতে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হওয়া আবাসন সংকটের মূল কারণ। মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তদের ঋণের জোগান দিতে ২০০৭ সালের ১৮ জুলাই পুনঃঅর্থায়ন তহবিল চালু করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। এ তহবিলে প্রথম দুই বছর ৬০০ কোটি ও ২০০৯ সালে ৫০০ কোটি টাকা দেয় সরকার। মাসিক আয় ৫০ হাজার টাকার কম, তাঁদের ফ্ল্যাট কিনতে বাণিজ্যিক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ঋণ দেওয়া হতো। এক হাজার ২০০ বর্গফুট পর্যন্ত ফ্ল্যাট কিনতে ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ পাওয়া যেত। ৯ শতাংশ সুদে ৭৬ কিস্তিতে ২০ বছরের মধ্যে পরিশোধের শর্ত ছিল। কিন্তু আবাসনকে ‘অনুৎপাদনশীল’ হিসেবে চিহ্নিত করে ২০১০ সালের এপ্রিলে তহবিলটি বন্ধ করে দেওয়া হয়।
রিহ্যাবের সভাপতি আলমগীর শামসুল আলামিন বলেন, ‘আমরা দীর্ঘদিন ধরে ২০ হাজার কোটি টাকার একটি তহবিলের ব্যাপারে বলে আসছি। কিন্তু এখন পর্যন্ত তার কোনো সাড়া পাইনি। তহবিলটি কোম্পানিদের জন্য নয়। এটি মূলত নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষের জন্য। তাঁরা কম সুদে এ তহবিলের ঋণ পেলেই আবাসন খাত ঘুরে দাঁড়াবে।’
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.