ঢাকার ফুটপাতে বছরে প্রায় ১ হাজার ৮২৫ কোটি টাকা চাঁদাবাজি হয়, যা দুই সিটি করপোরেশনের সম্মিলিত বাজেটের প্রায় সমান। একটি গবেষণা প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) ‘নগর পরিস্থিতি ২০১৬: ঢাকা মহানগরে যানজট-শাসন-ব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে’ নামের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, দুই সিটি করপোরেশন মিলে ঢাকার ফুটপাতের দৈর্ঘ্য ৪৩০ কিলোমিটার। এই ফুটপাত দখল করে অবৈধ পথে হকারদের ব্যবসা চলে। প্রতিবেদন অনুসারে, ঢাকার রাস্তায় আড়াই লাখের বেশি হকার ব্যবসা করে। ফুটপাতে বসতে একজন হকারকে এলাকাভেদে ৫০ থেকে ৩০০ টাকা লাইনম্যানদের দিতে হয়। লাইনম্যানদের মাধ্যমে এই টাকার ভাগ চলে যায় রাজনৈতিক নেতা, আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসহ বিভিন্ন মহলে। অংশীজন ও অন্যান্য উৎস থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে এই প্রতিবেদন বলছে, বছরে হকারদের কাছ থেকে তোলা চাঁদার পরিমাণ প্রায় ১ হাজার ৮২৫ কোটি টাকা। এই অঙ্ক ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মোট বাজেটের কাছাকাছি এবং রাজস্ব বাজেটের চেয়ে বেশি। এর পুরোটাই চলে যাচ্ছে চাঁদাবাজ ও অদৃশ্য নিয়ন্ত্রকদের পকেটে। নিউমার্কেট ফুটপাতে তিন বছর ধরে জুতার ব্যবসা করেন এমন একজন ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, তিন ফুট জায়গার জন্য মাসে প্রায় ১২ হাজার টাকা লাইনম্যানদের দিতে হয়। তিনি বলেন, ‘ট্যাকা না দিলে বইতে দিবো না।’ হকারদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নিউমার্কেট এবং এর আশপাশের এলাকায় ভ্রাম্যমাণ ও ফুটপাতে বসা হকারদের দিনে ন্যূনতম ৫০ থেকে ৩০০ টাকা দিতে হয়। গুলিস্তান এলাকায় দৈনিক চাঁদার হারও প্রায় একই রকম। কারওয়ান বাজারে রাস্তার পাশে টুকরি নিয়ে বসতে দিনে ১৬০ টাকা দিতে হয়। আর ফুটপাতে চা-জুতার স্থায়ী দোকানের ভাড়া মাসে আড়াই থেকে তিন হাজার টাকা বলে জানান বিক্রেতারা। হকার সমন্বয় পরিষদের সমন্বয়ক আবুল হোসাইন বলেন, দুই সিটি করপোরেশন মিলে হকারের সংখ্যা প্রায় পাঁচ লাখ। তাদের কাছ থেকে দিনে ২০ থেকে ১০০ টাকা চাঁদা নেওয়া হয়। তিনি বলেন, ‘হিসাব করলে অনেক টাকা। এটা তো সরকারকে রেভিনিউ হিসেবে আমরা দিতে পারি, যেটা বাইরে দিচ্ছি। উচ্ছেদ কোনো সমাধান নয়।’ বিআইজিডির এই গবেষণায় হকারদের দেওয়া টাকাকে আনুষ্ঠানিক রাজস্বে রূপ দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। গবেষণা দলের প্রধান শাহনেওয়াজ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা উচ্ছেদের কথা বলছি না। হকারদের থেকে পাওয়া বিশাল অঙ্কের টাকা সিটি করপোরেশনের রাজস্ব খাতে যোগ করার কথা বলছি।’ তিনি বলেন, হকারদের পরিচয়পত্র ও লাইসেন্স প্রদানের মাধ্যমে তাঁদের একটি ব্যবস্থার আওতায় আনা যায়। আর যে এলাকার হকারদের থেকে বেশি রাজস্ব আসবে, সেই এলাকার পুলিশদের জন্য আর্থিক প্রণোদনার ব্যবস্থা করা এবং লাইনম্যানদের ব্যবস্থাপনার আনুষ্ঠানিক দায়িত্ব দেওয়া হলে অবৈধ আয়ের বিষয়টিও কমে যাবে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, হকাররা অর্থনীতির একটা বড় অংশ। কিন্তু হকারদের সঠিক সংখ্যাই কোনো কর্তৃপক্ষ জানে না। এদের নিয়ে রাজউক ও সিটি করপোরেশনের সার্বিক পরিকল্পনা দরকার। দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা খান মোহাম্মদ বিলাল এ বিষয়ে বলেন, ‘ফুটপাত হাঁটার জন্য, হকারদের জন্য নয়। তবু আমরা চেষ্টা করছি হকারদের একটা নিয়মের মধ্যে আনতে। আপাতত বিকেলের পর এবং ছুটির দিনগুলোতে হকারদের বসতে দেওয়ার কথা হয়েছে। ওদের ডেটাবেইসও তৈরি করছি। বর্তমান অবস্থায় আয়ের সিংহভাগই ওদের হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। একটা নিয়মে এলে ওরাও লাভবান হবে।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.