তাঁরা আটজন। কেউ পড়েছেন হিসাববিজ্ঞানে, কেউ গণিত। কারও বাড়ি সিলেট, আবার কারও বেড়ে ওঠা কুমিল্লায়। একেকজন একেক কলেজে পড়েছেন। প্রত্যেকের গল্পগুলোও আলাদা, অদ্ভুত, অনুপ্রেরণাদায়ী! আটজনের মধ্যে মিল একটাই—ভালো ফলাফলের জন্য ১৭ জানুয়ারি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম সমাবর্তন অনুষ্ঠানে তাঁরা স্বর্ণপদক পেয়েছেন। কৃতী শিক্ষার্থীরা বলেছেন তাঁদের গল্প। সঙ্গে ছিলেন মো. সাইফুল্লাহ ।
মোহাম্মদ শাহাদাৎ হোসেন
ক্লাস মিস করিনি
মোহাম্মদ শাহাদাৎ হোসেন বাংলা; চাঁদপুর সরকারি কলেজ, স্নাতকোত্তর-২০১১ প্রথম শ্রেণিতে প্রথম বাবা নেই, মামা ছিলেন আমার অভিভাবক। তাঁর পরামর্শেই চাঁদপুর সরকারি কলেজে ভর্তি হই। মনে আছে, প্রথম বছরে ১৭৪টা ক্লাস হয়েছিল, আমি ১৭৩টা ক্লাস করেছি। একটা ক্লাস শুধু করতে পারিনি। পরের বছরগুলোতেও আমার লক্ষ্য ছিল একই, যত যা-ই হোক, ক্লাস মিস করব না। ইংরেজি ছিল নন-মেজর সাবজেক্ট। বাংলার ছাত্র আমি, ইংরেজিটাও খুব ভালো জানতাম। এলাকায় ইংরেজির শিক্ষক হিসেবে সুনাম ছিল। টিউশনি করতাম, ব্যাচে পড়াতাম। স্নাতকের ছাত্র থাকা অবস্থায়ই মাসে ৭০-৮০ হাজার টাকা আয় হতো। সে সময়ই পরিবারের দায়িত্ব নিতে শিখেছিলাম।
এখন ঢাকার বিএএফ শাহীন কলেজের বাংলা বিভাগের প্রভাষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি। স্বর্ণপদক পেয়ে খুব ভালো লাগছে।
ভালো করার আগ্রহ ছিল
মুহাম্মদ এরশাদ উল্লাহ ইসলামিক স্টাডিজ; কবি নজরুল সরকারি কলেজ, স্নাতক ২০১০, প্রথম শ্রেণিতে প্রথম আমরা আট ভাই, এক বোন। বাবা ফেনীর সোনাগাজী উপজেলার আমিরাবাদ মোশাররফ মোয়াজ্জেম ইসলামিয়া আলিম মাদ্রাসার শিক্ষক। ছোটবেলায় সেখানেই পড়েছি। আমরা ভাইবোনেরা সবাই পড়ালেখায় ভালো। আমি পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণিতে বৃত্তি পেয়েছি। দাখিল পরীক্ষায় মাদ্রাসা বোর্ডে সপ্তম হয়েছিলাম। তাই কলেজেও ভালো করার আগ্রহ ছিল। আমাদের শিক্ষকেরা খুব ভালো ছিলেন। নিয়মিত ক্লাস নিয়েছেন। তাঁদের সহায়তায়ই পরীক্ষার ফল ভালো হয়েছে। প্রথম সমাবর্তনের খবর পেয়ে এই সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইনি। স্বর্ণপদক নেওয়ার ছবি মা-বাবা, এলাকার লোকজন টিভিতে দেখেছেন। তাঁরা সবাই খুশি। আমি এখন ডি এস মদিনাতুল উলুম সিনিয়র মাদ্রাসার প্রভাষক। আমার শিক্ষার্থীরাও শিক্ষকের অর্জন নিয়ে খুব আনন্দিত।
হাল ছেড়ে দিতে পারি না
শাম্মী আক্তার অর্থনীতি; ইডেন কলেজ, স্নাতক ২০১২ প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষে পড়ার সময় আমার বিয়ে হয়। শেষ বর্ষের পরীক্ষা যখন এগিয়ে এসেছে, তখন আমি সন্তানসম্ভবা। স্বামী ব্যারিস্টার ফজলে এলাহী, বাবা ও আমার শ্বশুরের অনুপ্রেরণায় তখনো পড়ালেখা থামাইনি। ক্লাস করেছি, স্যারের কাছে পড়েছি। শ্রীমঙ্গলের প্রত্যন্ত অঞ্চলের স্কুল–কলেজ থেকে মাধ্যমিক–উচ্চমাধ্যমিক পেরিয়ে আমি ঢাকায় এসে ইডেন কলেজে ভর্তি হয়েছি। এত দূর এসে এত সহজে তো হাল ছেড়ে দিতে পারি না। আমার প্রথম সন্তানের নাম রেখেছিলাম আজিজা এলাহী পারিশা। স্নাতকোত্তর পরীক্ষার কিছুদিন আগে একটা সড়ক দুর্ঘটনায় আমার ছয় মাস বয়সী মেয়েটা মারা গেল। আমার হাত ভেঙে গিয়েছিল। প্রচণ্ড মন খারাপ নিয়ে তবু স্নাতকোত্তর পরীক্ষা দিয়েছি, সেবার ফল ভালো হয়নি। আমার দ্বিতীয় সন্তানের বয়স এখন ৩ মাস, নাম রেখেছি আতিয়া এলাহী। সংসারের দেখাশোনার পাশাপাশি আমি বিসিএসের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি ।
বাবার স্বপ্ন পূরণ করেছি
আকলিমা ভূঁইয়া প্রাণিবিজ্ঞান; খিলগাঁও মডেল কলেজ, স্নাতকোত্তর ২০০৮ প্রথম শ্রেণিতে প্রথম মেডিকেলে পড়তে চেয়েছিলাম। সুযোগ পেলাম না। বাসার সবাই বিরক্ত, রাগ। আর আমি হতাশ। প্রথমে ইডেনে বাংলায় ভর্তি হয়েছিলাম। বাংলা অনেক কঠিন মনে হচ্ছিল, আর যাতায়াতটাও খুব কষ্টকর। বাসা থেকে বলল, এত দূরে যাওয়ার দরকার নেই, তুমি বাড়ির কাছে খিলগাঁও মডেল কলেজে পড়ো। কলেজের প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান মিহির রঞ্জন দে স্যার আমার সব হতাশা দূর করে দিলেন। শুরু থেকেই স্যার ভীষণ উৎসাহ দিয়েছেন, যত্ন নিয়েছেন। আমাদের ব্যাচে দুজন ছাড়া সবাই প্রথম বিভাগ পেয়েছিল, সবই স্যারের কৃতিত্ব। স্যার আমাদের পড়তে বাধ্য করেছেন।
আমি কিন্তু খুব বেশি পড়িনি। তবে প্রতিদিন পড়তাম, অল্প একটু হলেও। এখন ন্যাশনাল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের সিনিয়র শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি। ছাত্রছাত্রীদেরও আমি এই শিক্ষা দিই। আমার বাবা মো. আবদুস সামাদ বলতেন, ‘আমি সন্তানের পরিচয়ে পরিচিত হতে চাই।’ এখন মনে হয়, তাঁর স্বপ্ন কিছুটা হলেও পূরণ করতে পেরেছি।
জিনের বাদশাহর ফোন!
মোহাম্মদ শাফায়েত আলম গণিত; গুরুদয়াল সরকারি কলেজ, কিশোরগঞ্জ, স্নাতক ২০১২, প্রথম শ্রেণিতে প্রথম প্রথম যখন ফোন করে বলা হলো, ‘আপনি স্বর্ণপদক পাচ্ছেন। অনুমোদনের ব্যাপার আছে, তাই এখনই কাউকে জানাবেন না।’ আমি বিশ্বাস করতে পারিনি। যেহেতু কাউকে জানাতে নিষেধ করা হয়েছিল, তাই আরও সন্দেহ হচ্ছিল। ভেবেছিলাম, বোধ হয় ‘জিনের বাদশাহ’-টাইপের কারও ফোন, আমাকে বোকা বানানো হচ্ছে! সত্যি সত্যিই স্বর্ণপদক পাব ভাবিনি। আমি ৩ বোনের একমাত্র ভাই। বাবা শিক্ষক, আমরা ভাইবোনেরা সবাই ছোটবেলা থেকে পড়ালেখায় ভালো ছিলাম। গণিত খুব মজা লাগে। তাই স্নাতকে খুব আগ্রহ নিয়ে পড়েছি। এখন একটা প্রত্যন্ত অঞ্চলে, কাঞ্চনপুর হাওড়া স্কুলে বাচ্চাদের পড়াই। গণিতে যে মজা আমি পাই, সেটাই আমার ছাত্রছাত্রীদের দিতে চেষ্টা করি।
নিজের সেরাটা দিতে চাই
হোমায়রা ইসলাম ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং; ঢাকা সিটি কলেজ, স্নাতক ২০১২ প্রথম শ্রেণিতে প্রথম ছোটবেলায় ভালো ছাত্রী ছিলাম। মুন্সিগঞ্জের রামপাল স্কুল অ্যান্ড কলেজে পড়েছি। ইচ্ছা ছিল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ব। কিন্তু পরীক্ষার সময় টাইফয়েড হয়েছিল বলে স্বপ্ন পূরণ হলো না। ভর্তি হলাম সিটি কলেজে। ঢাকার আজিমপুরে একটা হোস্টেলে থেকে পড়ালেখা করেছি। প্রথম দিকে খুব কষ্ট হতো। খেতে পারতাম না। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে না পারার দুঃখ আর জেদ—দুটাই খুব কাজে এসেছে। আমি সব জায়গায় নিজের সেরাটা দিতে চেষ্টা করি। এখানেও তা-ই করেছি। হোস্টেলে বড় আপুরা ছিলেন, তাঁদের সাহায্য পেয়েছি। আর সব সময় সাহস দিয়েছেন আমার মা হাসনা বেগম।
৩৫তম বিসিএসে প্রশাসন ক্যাডারে সুযোগ পেয়েছি। কর্মক্ষেত্রে যেহেতু দেশের মানুষের সেবা করার সুযোগ আছে, এখানেও আমি আমার সেরাটাই দিতে চাই।
ক্রিকেট ছিল আমার সব
মো. মতিউর রহমান রাষ্ট্রবিজ্ঞান; ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজ, কুমিল্লা, স্নাতকোত্তর ২০১০, প্রথম শ্রেণিতে প্রথম মাধ্যমিকে আমার জিপিএ ছিল ৩.০। উচ্চমাধ্যমিকে ৪.৩০ পেয়ে একরকম পড়ালেখা ছেড়েই দিয়েছিলাম। আমার ধ্যানজ্ঞান সব ছিল ক্রিকেট। দুবার পায়ের লিগামেন্ট ছিঁড়েছে, তারপর খেলা থেমেছে। পড়ালেখা করতাম না বলে মা-বাবা আমার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছিল। কুমিল্লা শহরে এসে একা থাকতাম। মামাতো ভাই আল-ইমরান ভিক্টোরিয়া কলেজের ফরম কিনেছিল। ওর জোরাজুরিতে আমিও পরীক্ষা দিলাম, চান্স পেলাম, ও-ই ভর্তির ব্যবস্থা করল। ভালো ছাত্র ছিলাম না, কিন্তু আমার হাতের লেখা খুব সুন্দর ছিল। প্রথম ক্লাসে তানজিদা খানম ম্যাডাম বললেন, ‘তোমার লেখা এত সুন্দর, তুমি পড়ালেখাটা একটু মন দিয়ে করো।’ এরপর কোনো পরীক্ষায় আমি দ্বিতীয় হইনি। স্নাতক, স্নাতকোত্তরেও প্রথম শ্রেণিতে প্রথম।
সব কঠিন সময়ে পাশে ছিল আমার তিন বন্ধু—সুমন, শারমিন ও সোবহান। আর ভীষণ সহযোগিতা করেছিলেন বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ফাতেমা নূরুন নাহার আপা। অনেকগুলো টিউশনি করতাম। স্নাতকে পড়ার সময়ই মা-বাবা-ছোট ভাইবোনদের আমার সঙ্গে এনে রেখেছি, সংসারের দায়িত্ব নিয়েছি। এখন একটা ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি। সম্প্রতি ৩৫তম বিসিএসে উত্তীর্ণ হয়েছি।
সূএ: ইন্টারনেট
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.