আমেরিকা এসে প্রথম প্রথম আমরা স্বামী-স্ত্রী দুজনই অনেক দিন খাঁটি বাঙালি স্টাইলে কার্পেটের ওপর গ্লাস-প্লেট নিয়ে বসে খাওয়া দাওয়া করতাম। এভাবে বেশ কয়েক মাস যাওয়ার পর একদিন বেশ আচানকভাবেই একখানা ডাইনিং টেবিল কিনে ফেলা হলো। আমের সঙ্গে যেমন ছালা লাগে, ঠিক তেমনি টেবিলের জন্য টেবিল ক্লথ আর চেয়ারের জন্য কভার কিনে ফেললাম আমরা। মাঝে বেশ অনেক দিন কার্পেটে বসে খাওয়া দাওয়া করে অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল। তাই টেবিল আসার পর আবিষ্কার করলাম আমরা চেয়ারে দুই পা তুলে আয়েশ করে বসে খাওয়া দাওয়া করতে ভালোবাসি। এরপর ভাবলাম, নাহ, অভ্যাস খারাপ হয়ে যাচ্ছে। কোনো দিন দেখা যাবে কোনো বাসায় দাওয়াত খেয়ে গিয়ে দুই পা চেয়ারে তুলে ভাঁজ করে খেতে বসেছি। তখন দৃষ্টিকটু লাগবে। সে কারণে ভদ্র হয়ে গেলাম। এভাবে কয়েক মাস যাওয়ার পর একদিন শুনলাম আমাদের খুব প্রিয় এক ভাইয়া আর ভাবি তল্পিতল্পা গুটিয়ে অন্য স্টেটে চলে যাচ্ছেন। ওনাদের ডাইনিং টেবিলটা চমৎকার ছিল। আমরা সেই টেবিল কিনে নিলাম। এরপর ঘরে দুখানা ডাইনিং টেবিল। স্বামী মহাশয়কে ভাব নিয়ে বললাম, সকালে এই টেবিলে নাশতা করব আর রাতে ওই টেবিলে ডিনার করব। এলাহি ব্যাপার হবে একদম! সে বলল, এক কাজ কর, নাশতা খেয়ো এই টেবিলে, পানি খেয়ো অন্য টেবিলে। ভাত থাকবে এক টেবিলে, তরকারি অন্য টেবিলে। এভাবে দুই টেবিলই ব্যবহার করতে পারবে। আমি কটমট করে তাঁর দিকে ‘ভর্তা বানিয়ে ফেলব’ লুক দিলাম। বেচারা চুপ মেরে গেল। কিছুদিন যাওয়ার পর ঘরে দুই টেবিল থাকার উচ্ছ্বাস কমে গেল। ড্রয়িংরুমের মাঝখানে গাবদা সাইজের একটা টেবিল আর চারখানা চেয়ার ফ্যাল ফ্যাল করে সারা দিন তাকিয়ে আছে। এমনটা দেখলেই আমরা মেজাজ গরম হয়ে যেতে থাকল। ভাবলাম এবার সময় হয়েছে ক্রেগলিস্ট আর মার্কেটপ্লেসে বিজ্ঞাপন দিয়ে এই টেবিলকে বিদায় করতে হবে। স্বামী মহাশয় টেবিলের অসাধারণ বিবরণ লিখে বিজ্ঞাপন দিল। এমনভাবে লিখল যেন এই টেবিল না কিনলে যে কারও জীবনে বিরাট ক্ষতি হয়ে যাবে। বিজ্ঞাপন পোস্ট হওয়ার কয়েক মিনিটের মাথায় ডজন ডজন মানুষ ওকে মেসেজ দিতে শুরু করল। কেউ দামাদামি করে, কেউ জানতে চায় কত দিন হলো কিনেছি, কেউ পারলে এখনই নিয়ে যায়। ওতো মহা উত্তেজিত হয়ে গেল। গণহারে সবার মেসেজের উত্তর দিতে দিতে আমাকে বলল, আরে, জিনিসপত্র বিক্রি করা দেখি খুবই আনন্দের। বাসায় আর কী কী আছে বল, সব বিক্রি করে দেব। আমি ওর এত আনন্দ দেখে শঙ্কিত হয়ে গেলাম। আসলেই সব বিক্রি করে দেবে নাকি!
প্রথমে অবস্থা এমন ছিল যে, সেদিনই পারলে কেউ এসে টেবিল নিয়ে যায়। কিন্তু পরে দেখা গেল সবাই আজকে আসব, কালকে আসব বলে শেষ পর্যন্ত কেউই আসছে না। কয়েকজন আবার টেবিলের দাম অর্ধেকের অর্ধেক করে সেটাকে অর্ধেক নিয়ে ভাগ করে দাম হাঁকছে। আমাদের মেজাজ গরম হয়ে গেল। ঠিক করলাম উল্টাপাল্টা দাম বললে আর এত আগ্রহ নিয়ে উত্তর দেব না। এভাবে সপ্তাহখানেক কাটল। টেবিল ড্রয়িংরুমে আয়েশ করে থাকে। আমি দুই দিন পরপর ধুলা মুছি। তারপর ভাবলাম যা থাকে কপালে এবার আমি নতুন করে বিজ্ঞাপন দিই। টেবিলের বেসিক তথ্য, রং, আকার-আয়তন, আর দাম লিখে আমি পোস্ট দিলাম। মানুষজন আমাকে মেসেজ দিতে শুরু করল। আমি গম্ভীরভাবে সেগুলোর উত্তর দিতে থাকলাম। এর মাঝে দুজন আবার স্প্যানিশ লিখে মেসেজ দিল। আমি প্রথমে কিছু না বুঝে ইংরেজিতে রিপ্লাই দিলাম। তারা আবার স্প্যানিশ লিখে দিল। একজন আবার লিখল no inglesh. বেশ কিছুক্ষণ পর বুঝলাম আসলে সে কী বলতে চেয়েছে। কিবোর্ডে মোটামুটি একটা হাই জাম্প দিয়ে আমি গুগল ট্রান্সলেটরে চলে গেলাম। একবার ইংলিশকে স্প্যানিশ করি তো একবার স্প্যানিশকে ইংলিশ করি। এভাবে মোটামুটি দশ মিনিট কথা চালিয়ে গেলাম। দুজনের মধ্যে একজন বলল, পরের দিন সে অবশ্যই টেবিল দেখতে আসবে। আমি তো মহাখুশি। স্বামী মহাশয় চিন্তিত হয়ে বলল, বাসায় আসলে কীভাবে কথা বলবে? তখনো কি গুগলে আগে ট্রান্সলেট করে নিবে? আমি বললাম, অল্পস্বল্প স্প্যানিশ তো আমি পারি। ম্যানেজ করে ফেলব। ও বলল, দেখবে কেউই আসবে না। শুধুই কষ্ট করলে এত! পরদিন বিকেল পৌনে চারটায় কল এল। এক লোক একগাদা কথা বলে গেল। আমার স্বামী ব্যাপকভাবে ফোনে মাথা নেড়ে নেড়ে খালি ইয়েস, ইয়েস ডাইনিং টেবিল বলে গেল। তারপর ফোন রেখে আগুন দৃষ্টিতে আমাকে বলল, ব্যাটা খুব সম্ভবত টেবিল দেখতে বাসায় আসবে। আমি বললাম, কীভাবে বুঝলে? ও চোখ কটমট করে বলল, আন্দাজ করে নিলাম আর কি। আমি তাড়াতাড়ি গুগল ট্রান্সলেটে গিয়ে স্প্যানিশ দেখে সেই লোককে মেসেজ দিলাম—আমরা তোমার জন্য অপেক্ষা করছি। তুমি আস। কিছুক্ষণ পরে সেই লোক মেসেজ দিল বাসা খুঁজে পাচ্ছে না। আমরা তাঁকে খুঁজতে গেলাম। স্বামী আমাকে বলল, দেখা হলে চিনবে কীভাবে? Hola, como estas (হ্যালো আপনি কেমন আছেন) বলে রাস্তায় চেঁচাতে থাকবে? আমি বললাম, দরকার হলে চেঁচাব। কোনো সমস্যা? প্রায় মিনিট সাতেক পর অবশেষে সেই লোককে খুঁজে পেলাম। ফরমাল শার্ট প্যান্ট পরা, লম্বা চওড়া এক মধ্যবয়স্ক লোক। চকচকে একটা SUV চালিয়ে এসেছে। আমাদের দেখেই গাড়ি থেকে নেমে এসে হাত বাড়িয়ে দিল। আমি বললাম, Sígueme, মানে আমাদের ফলো করো। বাসায় যেতে যেতে যতটুকু স্প্যানিশ পারি তা আওড়ে নিচ্ছিলাম আর ভাবছিলাম টেবিল দেখে সে দামাদামি করলে আমি কীভাবে ম্যানেজ করব? সেই লোক বাসায় এল। মিনিট দু-এক টেবিল-চেয়ার দেখে কোনো কথা না বলে, মানিব্যাগ থেকে ডলার বের করে ইশারা করল, সে এখুনি টেবিল নিয়ে যাবে। আমরা দুজনে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলাম। তারপর ধরাধরি করে তিনজন মিলে টেবিলে-চেয়ার গাড়িতে তোলার উদ্যোগ নিতে থাকলাম। চেয়ার নিতে নিতে আমি ভাঙা ভাঙা স্প্যানিশে বললাম, আমি অল্পস্বল্প স্প্যানিশ জানি। কেমন আছ, ভালো আছ, ক্ষুধা লেগেছে, টয়লেটে যাব, এই টুকটাক আর কি। ভদ্রলোক এতটুকু শুনেই আনন্দে হড়বড় করে কী যেন বলতে লাগলেন, যেগুলোর দুই-একটা শব্দ বাদে আমি কিছুই বুঝলাম না। এদিকে স্বামী মহাশয় তো আমাদের কথোপকথন দেখে হতাশ হয়ে মাথা নাড়তে লাগল। টেবিল-চেয়ার খুব কায়দা করে গাড়িতে তোলার পর সেই ভদ্রলোক আমাদের বললেন, gracias মানে ধন্যবাদ। আমি বললাম, ten un buen dia. হা হয়ে তাকিয়ে থেকে পাশ থেকে ফিসফিস করে স্বামী বলল, বিজাতীয় ভাষায় কি বললে? আমি বিজ্ঞের মতো পার্ট নিয়ে বললাম, বলেছি, ওনার দিনটা যেন ভালো যায়। আর দেখলে তো এত কষ্ট করে কথাবার্তা চালানোর লাভ কত? ভাগ্যিস, গুগল ট্রান্সলেটর ছিল। ফাউ নোট: আমাদের দেশে কাকা মানে আংকেল আর ওদের দেশে কাকা মানে মল। মল মানে ইয়ে আর কী! একেই বলে এক দেশের গালি অন্য দেশের বুলি…।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.